এবারের রোটা ভাইরাস কনফারেন্স ছিল কেপ টাউনে। দক্ষিণ আফ্রিকার এই শহরটি প্রকৃতির এক শিল্পকর্ম, যার সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। পাহাড়, সমুদ্র, ঝকঝকে নীল আকাশ, প্রানী বৈচিত্র্য আর তার সাথে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস- সব মিলে কেপ টাউন দেখার সবপ্ন আমার অনেকদিনের। অতএব আমার বাকেট লিস্ট লম্বা। লিস্টের প্রথমেই আছে দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক রোবেন দ্বীপ জাদুঘর (Robben Island Museum)! দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত, বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর ২৭ বছর কারাজীবনের ১৮ টি বছর বন্দী ছিলেন এই দবীপের কারাগারে । ১৯৯৯ সালে এই কারাগারটি জাদুঘরে রুপান্তরিত হয় এবং ইউনেস্কোর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
অতলান্তিক মহাসাগরের পারে এই রোবেন দ্বীপ, ওয়াটারফ্রন্টের নেলসন ম্যান্ডেলা গেইট থেকে দ্বীপে যেতে হয় ফেরীতে করে। সব মিলে আধা বেলা সময় বরাদ্ধ করা লাগবে রোবেন দবীপের জন্য। কনফারেন্সে ভ্রমন ইচ্ছুক লোকজন অনেক পেয়েছি, কিন্তু রোবেন দ্বীপে যাবার সঙ্গী খুঁজে পেলাম না। অন্যদিকে, রোবেন দ্বীপ না দেখে কেপ টাউন থেকে আমার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। কারণ এই দ্বীপের সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক ভয়ানক কালো অধ্যায় এবং একজন সুপার হিরো, যিনি নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সারাজীবন লড়ে গেছেন। আমাদের প্রজন্মের কাছে নেলসন ম্যান্ডেলা সেই সুপার হিরো, আর তাঁর আইকনিক বজ্রমুষ্টি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। ইতিহাস পড়ে চেনা সেই সুপার হিরোকে সামনা সামনি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, সেই স্মৃতি আমার ঝুলিতে মহামূল্যবান স্মৃতিগুলোর অন্যতম। ১৯৯৯ সালে আমি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ANU) র পি এইচ ডি স্টুডেন্ট। ঐ বছর আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যান্ডেলাকে আইন বিষয়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়া হয়। দিনটি ছিল ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সাল। লিওলিন হলের মঞ্চে বসেছিলেন জনা বিশেক বরেন্য ব্যক্তিত্ব। প্রায় দুঘণ্টা ব্যাপী চলা সেই অনুষ্ঠানের পুরো সময়টুকু আমার দৃষ্টি আটকে ছিল সব সাদা মানুষদের মাঝে বসে থাকা একমাত্র কালো মানুষটিতে, তাঁর ব্যক্তিত্ব চারপাশে যেন আলো ছড়াচ্ছিল।
রোবেন দ্বীপে যাবার ফেরীর টিকেট কাটতে হয় অনলাইনে। প্রতিদিন কয়েকবার করে অনলাইন চেক করছি, আর হতাশ হচ্ছি। প্রচণ্ড বাতাসের কারণে ফেরী বন্ধ দুদিন ধরে। আমার কেপ টাউনের শেষ দিন এসেই গেল। ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম ঝকমকে দিন। কিন্তু দু’দিন ফেরী বন্ধ থাকার কারণে অনলাইনে সব টিকেট সোলড আউট। কিছুটা দমে গেলেও হাল ছাড়ার পাত্রী আমি না। সিদ্ধান্ত নিলাম শেষ চেষ্টা করেই দেখি। সারাদিনের জন্য ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে উবার ডাকলাম ফেরিঘাটে যাবার জন্য- মনে মনে ক্ষীণ আশা যদি শেষ মুহূর্তে কেউ ফেরী মিস করে! কাউন্টারে গিয়ে জানলাম – আজকের কোন টিকেট নেই, ৯ টার ফেরির গেট অলরেডি বন্ধ হয়ে গেছে। হতাশ আমি বন্ধ গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম গেইটের ওপাড় থেকে এক ভদ্রলোক আমাকে ইঙ্গিত করছেন গেইট থেকে সরে যেতে। নিজেকেই যেন বললাম -রোবেন দ্বিপে তো আর যাওয়া হবেনা, ফেরীর পথটুকু না হয় দেখি। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে গেইট খুলে এপারে এলেন ভদ্রলোক। আমাকে পাশ কাটিয়ে গটগট করে টিকেট কাউনটারের দিকে গেলেন, মিনিট খানেকের মধ্যে ফিরে এসে বললেন “ফলো মি”। কাউনটারে গিয়ে বললেন বিকালের একটা টিকেট দিতে, আমাকে বললেন “পে নাউ”। ফেরীতে উঠার পরেও কিছুটা সময় ঘোরের মধ্যে ছিলাম- সত্যি আমার রোবেন দ্বিপে যাওয়া হচ্ছে!
ডেকে গিয়ে মন-প্রান জুড়িয়ে গেল। মনে হল ক্যানভাসে কোন শিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা ছবি দেখছি। অতলান্তিকের চারপাশ ঘিরে আছে টেবিলের আকৃতির পাহাড় (Table Mountain), নীল আকাশ মিশেছে পাহাড়ের চুড়ায়, পাহাড়ের কোল ঘেঁসে সমুদ্রের উত্তাল নীলাভ ঢেউ! যেন এক নীলপরী আকাশ থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে নাচতে নাচতে নেমে এসে সমুদ্রে সাঁতার কাটছে! চোখ জুড়ানো ছবিটি দেখতে দেখতে ফেরী দবীপে এসে পৌঁছাল।
ফেরী ঘাট থেকে দবীপে উঠার পর চোখে পড়লো কাঁটাতারে ঘেরা কারাগার, ব্যানারে লেখা “Freedom cannot be manacled” – “স্বাধীনতাকে হাতকড়া পড়িয়ে বন্দী করা যায়না”! প্রায় ছয় বর্গ কিলমিটারের দবীপটি হেঁটে দেখা সম্ভব নয় বলে ট্যুর বাসের ব্যবস্থা। বাসে উঠার পর গাইড মিস্টার ক্রেইগ বললেন, বাসে করে তিনি আমাদের রোবেন দবীপ ঘুরে দেখাবেন প্রথম এক ঘণ্টা, আর পরের এক ঘণ্টা কারাগারের ভিতরটা ঘুরে দেখাবেন একজন প্রাক্তন কয়েদী, তাঁর নাম টেরান্স পিয়েরস। ক্রেগ অনেকটাই দার্শনিক অধ্যাপকের মত, আর টেরান্স ঠিক তাঁর উল্টো- দেখেই মনে হয় বিপ্লবী। মাত্র ১৬ বছর বয়সে নাশকতার অভিযোগে ৫ বছর কারাগারে বন্দী ছিলেন টেরান্স। শুরুতে টেরান্স আমাকে বেশ কিছুটা চমকে দিয়েছিলেন। আমি যখন খুব গর্বিত কণ্ঠে নিজেকে বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিলাম, তিনি খুব কঠোরভাবে বললেন “lady, you have to leave my team. I can’t allow a Bangladeshi in my team”. অপ্রস্তুত হলেও আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। “কারণ তোমরা আমাদের মনে অনেক কষ্ট দিয়েছ”। তিনি ২০১৫ সালের কথা মনে করিয়ে দিলেন--সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়ে বাংলাদেশী টাইগাররা যখন প্রথমবারের মত ওয়ান ডে সিরিজ জিতেছিল। আমি হেসে বললাম “ঠিক একারণেই আমি আমাদের টাইগারদের ভালবাসি”!
ক্রেইগ এবং টেরান্সের বর্ণনা, তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কারাগারের ভিতরের সংরক্ষিত স্মৃতিগুলো বর্ণবাদের নিষ্ঠুর ইতিহাসকে নতুন করে যেন চোখের সামনে জীবন্ত করে তুলল। আফ্রিকায় বর্ণবাদের শুরুটা হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে, যখন ইউরোপীয়ান বণিকরা প্রথমবারের মতো কেপটাউন অঞ্চলে আসে। ১৮৩৪ সালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও কালো চামড়ার মানুষেদের উপর নির্যাতন কমেনি। বরং “পৃথকীকরণ আইন” (Apartheid law) পাশ করার মাধ্যমে বর্ণবাদ বৈধতা দেয়া হয় ১৯৪৮ সালে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ধরনের অধিকার থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের আলাদা রাখতে এই আইন করা হয়। আইন অনুযায়ী শ্বেতাঙ্গদের সাথে কৃষ্ণাঙ্গদের কোন সম্পর্ক করা তো দূরের কথা, একই এলাকায় বসবাস করাও ছিল আইনত নিষিদ্ধ। শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের ডাকতো “বান্টু” বলে, আর তাদের জন্য নির্ধারিত অঞ্চলের নাম দিয়েছিল ‘বান্টুস্থান’।
দুরন্ত নেলসন ম্যান্ডেলার শৈশবের নাম ছিল রলিলাহলা (troublemaker)। অল্পবয়সেই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ১৯৪৪ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তির দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগ দেন। ১৯৫২ সালে ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে বরনবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় । ১৯৬২ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, আর ১৯৬৪ সালে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত ম্যান্ডেলা বন্দী ছিলেন রবেন দ্বীপের কারাগারে।
দ্বীপজুড়ে বেশ অনেকগুলো ছোট ছোট কারাগার। কারাগারের দেয়ালে বন্দীদের চিঠি, তাদের খাবারের তালিকা স্মরণ করিয়ে দেয় নিষ্ঠুর ইতিহাস কে। অন্য বন্দীদের তুলনায় বানটুদের খাবারের মান ছিল নিম্নমানের এবং পরিমাণেও কম; মাংসের পরিমাণ কম, জুস বা চিনি ছিল নিষিদ্ধ। আমাদের গাইড টেরান্স পাঁচ বছর বন্দী জীবনের পর যেদিন ছাড়া পেয়েছিলেন, প্রথম কাজটি তিনি করেছেন এক কাপ কফি বানানো ; সে কফিতে দশ চামচ চিনি মিশিয়েছেন, সেটা খেতে নাকি খুবই বিস্বাদ ছিল।
বি ব্লকের ৫ নম্বর সেলে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন ম্যান্ডেলা। চার বর্গমিটারের ছোট একটি রুম, খাট বা চৌকি নেই। সাদা রঙের শিকের জানালা, জানালা বরাবর ছোট সবুজ কাঠের টেবিলের ওপর অ্যালুমিনিয়ামের একটি প্লেট আর বাটি। টেবিলটির বাম পাশে টিনের লাল ঢাকনিযুক্ত বালতি, যেটি রাতের বেলা বাথরুমের কাজে তাঁকে ব্যবহার করতে হত। ডানদিকে ঘুমানোর জন্য মাদুর আর একটি কম্বল।
ম্যান্ডেলার শিক্ষা, মূল্যবোধ আর দেশপ্রেমের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে-বিদেশে। বিশ্ব দরবারের চাপে ১৯৮৫ সালে বরনবাদী সরকার ম্যান্ডেলাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, শর্ত ছিল মুক্ত হবার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকবেন তিনি। দীর্ঘ কারাভোগও ম্যান্ডেলাকে তাঁর আদর্শ থেকে এতটুকু টলাতে পারেনি। সরকারের প্রস্তাব অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করেন তিনি, জানিয়ে দেন -যতক্ষণ তাঁর দেশের জনগণ স্বাধীন হবেনা, কোনো শর্তই তিনি মেনে নেবেন না। ম্যান্ডেলার দেশপ্রেমে তখন আলোড়িত পৃথিবী। ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পী জেরী ডামেরস লিখে ফেলেন ম্যান্ডেলার মুক্তির গান ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা’ । এই গানটি পরবর্তীতে বিক্ষোভের একটি গান হয়ে দাঁড়ায়।
২৭ বছর কারাভোগের পর অবশেষে ১৯৯০ সালে ম্যান্ডেলা মুক্তি পান। ১৯৯৪ সালে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলা একটি নতুন গণতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। শেষ হয় আফ্রিকার বর্ণবাদের কালো অধ্যায়। শৈশবের দুরন্ত রলিলাহলা একসময় হয়ে উঠলেন দক্ষিন আফ্রিকার “মাদিবা” (Father of the Nation)। ইতিহাসে শক্তিশালী, দেশপ্রেমিক নেতাদের অন্যতম ম্যান্ডেলা।
বিজয়ী হওয়ার পর ম্যান্ডেলা সাদা চামড়ার মানুষদের উপর প্রতিহিংসাপরায়ণ কোন আচরণ করেননি। বরং তিনি সাদা-কালোর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছেন আজীবন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যান্ডেলার প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিটি গঠন করা, যার মাধ্যমে ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বর্ণবাদী সরকারের আমলের সংঘটিত অপরাধগুলোর তদন্ত করা হয়। এই উদ্যোগটি বিভক্ত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা হয়। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে স্বৈরাচারী হবার প্রবনতা যাতে গড়ে না উঠে এই লক্ষ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা্ স্বত্বেও তিনি দ্বিতীয় টার্মের নিরবাচনে যাননি।
দবীপ থেকে ফেরার ফেরীতে বসে ভাবছিলাম, ৫৪ বছর কেটে গেল। এমন একজন দেশপ্রেমিক নেতা কবে পাবো আমরা, যার কাছে দেশের সবাধীনতা আর সার্বভৌমত্য থাকবে সবার উপরে। ব্যক্তি, পরিবার বা দলের আগে তিনি দেশের মানুষের স্বার্থ দেখবেন। প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ধর্ম, লিঙ্গ, অবস্থান বা মতাদর্শের কারণে কাউকে নিগৃহীত হতে হবে না। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে ।